ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৯/১০/২০২৩ ৩:৪৫ পিএম , আপডেট: ১৯/১০/২০২৩ ৩:৫৫ পিএম

কক্সবাজারে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে গত ৮ মাসে ৫৬টি সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৬৮ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে। খুনের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে এই আশ্রয়শিবিরে।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক পাচারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বারবার সংঘর্ষ ঘটছে এই আশ্রয়শিবিরে।

এ ছাড়া দুর্গম পাহাড়বেষ্টিত এই শিবিরে খুব কাছেই মিয়ানমার সীমান্ত হওয়ায় অপরাধ করে সহজেই গা ঢাকা দিতে পারছে সন্ত্রাসীরা। এ জন্য খুন, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ছে।

কেন বাড়ছে অপরাধ
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির আছে ৩৩টি। প্রায় আট হাজার একর বনভূমির ওপর গড়ে তোলা এই আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে।

শরণার্থীদের নিরাপত্তায় আশ্রয়শিবিরের চারদিকে লাগানো হয় কাঁটাতারের বেড়া। স্থাপন করা হয় ৩০টির বেশি পর্যবেক্ষণচৌকি। তারপরও প্রায় প্রতিদিন আশ্রয়শিবিরগুলোতে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

গত ৮ মাসে নিহত ৫৬ রোহিঙ্গার মধ্যে ১৭ রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা), ২১ আরসা সদস্য, ৩ আরএসও সদস্য ও ১ জন স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। খুন হওয়া অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ ৯ অক্টোবর উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে আরসা ও আরএসওর মধ্যে পৃথক গোলাগুলির ঘটনায় ছানা উল্লাহ (২৭) ও আহম্মদ হোসেন (৩৬) নামের আরসার দুজন সদস্য নিহত হন। এর আগে ৩ অক্টোবর রাতে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে এই গোষ্ঠীর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান আরসার শীর্ষ কমান্ডার মো. ইউসুফ (৩৮) ও আরএসও সদস্য মো. আরাফাত।

এসব সংঘর্ষের কারণ জানতে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বালুখালী আশ্রয়শিবিরের ৫৫ রোহিঙ্গা নেতা, স্বেচ্ছাসেবী, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের (আরআরআরসি) কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানিয়েছেন, বালুখালী আশ্রয়শিবিরের অবস্থান মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে স্থলপথে এবং নাফ নদী অতিক্রম করে সহজে এই আশ্রয়শিবিরে যাতায়াত করা যায়। ওই পথেই আসে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ (আইস), অস্ত্র, গোলাবারুদ, সোনাসহ নানা পণ্য। এ ছাড়া বালুখালী আশ্রয়শিবিরে তিন দিকেই উঁচু পাহাড়। আশ্রয়শিবিরে অপরাধ করে সন্ত্রাসীরা সহজেই পাহাড়ে গা ঢাকা দিতে পারে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ( আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়-জঙ্গলবেষ্টিত বালুখালী আশ্রয়শিবিরটি মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি এবং স্থলপথে যাতায়াতের সুবিধাও অনেক। এ কারণে সন্ত্রাসীরা নিরাপদ আস্তানা গড়ে তোলে এই আশ্রয়শিবিরে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালানসহ নানা কারণে শিবিরে খুনখারাবিও হয়। নাশকতার আগুনেও কয়েক দফায় বালুখালীর আশ্রয়শিবির ধ্বংস করা হয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন ১৩ জনের বেশি রোহিঙ্গা। পুড়েছে ১৫ হাজারের বেশি ঘর।

আশ্রয়শিবিরে এপিবিএন, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি সত্ত্বেও অপরাধ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বালুখালীতে টার্গেট কিলিং(চিহ্নিত করে খুন) বেড়েছে অনেক। এক দিনে ছয়জনকে হত্যার ঘটনাও আছে। এতে শরণার্থী সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত এনজিওর কর্মীরা ভয়ের মধ্যে আছেন। এ প্রেক্ষাপটে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মিলিত অভিযান চালানো হচ্ছে আশ্রয়শিবিরে।

আতঙ্কে শরণার্থীরা
বালুখালী আশ্রয়শিবিরে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার বসতি। শরণার্থীদের সারাক্ষণ অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের আতঙ্কে থাকতে হয়। গত মঙ্গলবার দুপুরে আশ্রয়শিবিরে কথা হয় রোহিঙ্গা সলিম উল্লাহর (৫৫) সঙ্গে। বাজারে তাঁর বড়সড় একটি দোকান আছে। দোকানে প্রতিদিন ৪০-৫০ হাজার টাকার জিনিস বিক্রি হয়।

সলিম উল্লাহ বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরের মধ্যে ২৩টি উখিয়াতে। এর মধ্যে বালুখালীতেই অপরাধ বেশি হয়। এই আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গারা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম স্থল সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে যাতায়াত করেন। অনেকে ইয়াবা, আইস ও সোনার চালান নিয়ে আসেন। র‌্যাব-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কিছু মাদক ও সোনা ধরা পড়লেও বেশির ভাগ চালান বালুখালী আশ্রয়শিবিরে মজুত করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, বালুখালীর আশ্রয়শিবিরেই ইয়াবা বিক্রির অন্তত ২৩০টি আখড়া রয়েছে। চাঁদার বিনিময়ে আখড়ার সুরক্ষা দেন আরসা, আরএসওসহ পাঁচ-ছয়টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা। আখড়া থেকে সুবিধাজনক সময়ে ইয়াবা ও আইসের চালান সরবরাহ হয় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মাদকের চালান আনে নবী হোসেন ও মুন্না বাহিনী।

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, কয়েক বছর আগেও আরসার সহযোগিতায় বালুখালী আশ্রয়শিবিরের মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করত নবী হোসেনের বাহিনী। বছর দুয়েক ধরে আরসাকে বাদ দিয়ে আরএসওর সহযোগিতায় মাদকের কারবার চালাচ্ছে নবী হোসেন বাহিনী। উখিয়ার মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, ময়নারঘোনা আশ্রয়শিবিরও নিয়ন্ত্রণ করে আরসা। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখন আরসা ও আএসও মুখোমুখি অবস্থানে। চাঁদার দাবিতে অপহরণের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এতে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক রোহিঙ্গা নারী বলেন, সন্ধ্যার পর আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। কিশোরী ও তরুণীদের গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়। দূরের নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে গেলে অপহরণ ও যৌন হয়রানির ঝুঁকি থাকে। গত সেপ্টেম্বর মাসে এই শিবিরে অন্তত ১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

গত রোববার রাতে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে আরসার কিলিং গ্রুপের প্রধান কমান্ডার নুর কামাল ওরফে সমিউদ্দীনকে (৪১)। র‌্যাব জানায়, নুর কামালের নেতৃত্বে বালুখালীসহ চারটি আশ্রয়শিবির নিয়ন্ত্রণ করত আরসা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আরসা মিয়ানমার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে।

গত ৯ মাসের অভিযানে কিলিং গ্রুপের প্রধানসহ আরসার ৭২ জনকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে। এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, আশ্রয়শিবিরের ভেতরে নাশকতা, অস্ত্র কেনাবেচা, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আরসাসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ১৫টি হত্যা মামলার পলাতক আসামি নুর কামালের কিলিং গ্রুপের হাতেই রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা রিজওয়ান রুশদী ও চাঞ্চল্যকর ছয় রোহিঙ্গা শিক্ষক-ছাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, নবী হোসেন বাহিনীর প্রধানসহ কয়েক শ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে এ থানায় সাতটির বেশি হত্যা ও অস্ত্র মামলা রয়েছে। তবে তাঁদের অনেকেই মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করায় ধরা যাচ্ছে না। সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালানো হচ্ছে। সোর্স, প্রথম আলো

পাঠকের মতামত

এমএসএফের প্রতিবেদন৮৪% রোহিঙ্গার আশঙ্কা—মিয়ানমারে ফেরা নিরাপদ নয়

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস/মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ)-এর নতুন একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, মিয়ানমারে চরম সহিংসতার ...